এটি ১৯৮৯ সালে “হৈমী”র রক্তদান শিবিরের স্মারক পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাটির পুনর্মুদ্রণ
শ্রী জনরঞ্জন গোস্বামী
সহযোগীতায়ঃ নির্মাল্য দাসগুপ্ত, শ্যামলবরন মুখাজ্জী, ও
নিশীথ চট্টোপাধ্যায় ।
প্রাক কথন
শত
বর্ষেরও আগে বঙ্গদর্শনের পাতায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখে ছিলেন “ বাংলার ইতিহাস চাই, নহিলে কখন মানুষ হইবে না”। এই
ইতিহাস কে রচনা করবে তার উত্তরে তিনি লিখলেন – তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই
লিখিব।.......... আইস আমরা সকলে মিলিয়া বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধান করি। যাহার যত দূর
সাধ্য সে তত দূর করুক। ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে। একের কাজ নয়,
সকলে মিলিয়া করিতে হইবে।– বঙ্গদর্শনের পাতায় এই লেখা বের হবার পর শতবর্ষে ভারত
ইতিহাস ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এ বিষয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক /স্থানীয়
ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধানের কাজ যথেষ্ট করা হয় নি। অথচ এর প্রয়োজনীয়তা কে অস্বীকার
করার কোন উপায় নেই। প্রাচীন বাংলায় আঞ্চলিক সত্তা প্রবল ছিল। কৃষি নির্ভর
মধ্যযুগেও তার রেশ ছিল। বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে মিলিয়ে বৃহত্তর বাঙ্গালী
জনেরও সৃষ্টি। আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে যেমন আমরা ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারি,
তেমনি এই সমাজের আবর্তন বিবর্তনের ধারা থেকে মানব ইতিহাসের গতি প্রকৃতিরও ইঙ্গিত
পেতে পারি। আঞ্চলিক ইতিহাস ছাড়া সমাজের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।
ঐতিহাসিক
না হয়েও স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা বঙ্কিমের লেখা পড়েই একসময়ে
এসেছিল। কাজ কিছুই এগোয় নি। কিছুদিন আগে “হৈমী”র অরূপ পাল, শ্যামল মুখাজ্জী ও
অন্যান্ন সদস্যরা তাদের ক্লাবের রক্তদান শিবিরের স্মারক পত্রিকায় শ্যামনগরের প্রাচীন
ইতিহাস কিছু লেখার জন্য অনুরোধ করেন। যে পরিমাণ অনুসন্ধান ও শ্রমের পর এ বিষয়ে
কিছু লেখার যোগ্যতা জন্মায় সে যোগ্যতা আমরা কেউই অর্জন করতে পারিনি। আমরা স্থানীয়
ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রস্তুতি নিয়েছি মাত্র। এই প্রস্তুতি পর্বে শ্যামনগরের
ইতিহাসের যে টুকু ইঙ্গিত পেয়েছি নীচের লেখায় তা তুলে ধরা হল। (এই পর্বে আমরা
শ্যামনগর এবং পরের পর্বে আতপুর এই ভাবেই ভেবেছি) সার্থক ইতিহাস রচনায় কি ভাবে
এগুতে হবে সে বিষয়ের ও ইঙ্গিত দেওয়া হল।
স্থানীয়
ইতিহাস রচনার কাজ টি অত্যান্ত দুরূহ। কারণ ইতিহাসের অপ্রতুলতা। স্থানীয় প্রাচীন
বাসিন্দারাও তাদের বক্তব্য প্রকাশ কালে সর্বদাই এতদঞ্চলের কয়েক জন বিখ্যাত
ব্যক্তিত্বের কার্যকলাপকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু ইতিহাস মানে তো কয়েকজন বিখ্যাত
ব্যক্তির জীবন নয়। দরিদ্র, ভূমিহীন বা স্বল্প ভূমির প্রজা, নিম্নবর্গের মানুষ এদের
কথাও ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। তারাই সমাজে সংখ্যা গরিষ্ঠ, এবং ইতিহাসের ধারক।
গ্রাম্য জন সাধারণের জীবনযাত্রা লোকধর্ম ও
অর্থনৈতিক যে ভিত্তির উপর সমাজটি প্রবাহমান ছিল এসব সম্পর্কে সবিস্তার আলোচনা ইতিহাস
কে পূর্ণতর করতে সক্ষম হবে।
ঐতিহাসিক
উপাদানের অভাবে আমরা হয়তো আপাতত ৩০০ বছরের বেশী প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে কিছুই বলতে
পারবো না অর্থাৎ ১৭ শতকের শেষ ভাগ থেকে এখানে যে আবর্তন ও বিবর্তনের ধারা প্রবাহিত
ছিল সেটা অন্বেষণই সাময়িক লক্ষ। এই সময়ের ধন উৎপাদনের উপায় ব্যবসা, বাণিজ্, কৃষি,
রক্ষণশীল গ্রাম্য জীবন, জমিদারি ব্যবস্থা , ধর্ম কর্ম , শিল্পায়ন শিক্ষা সংস্কৃতি
সবই আমাদের আলোচনার বিষয়। মনে রাখতে হবে ১৭দশ শতকের শেষ দিকে মোগল সাম্রাজ্য
অধোগতির দিকে যাচ্ছে , জব চার্নক কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলার জলপথে
পর্তুগিজ জলদস্যুদের আনাগোনা চলছে। শ্রীরামপুর, হুগলীতে বিদেশি বনিক ও জলদস্যুরা
ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে। সপ্তগ্রাম বন্দর তার প্রাচুর্যের দিন হারিয়ে ফেলেছে, তখন
বাংলার ক্ষয়িষ্ণু সমাজে কৌলীন্য প্রথা, সতীদাহ সবই চালু আছে আর বাংলার মানুষ
অর্থের জোগান দিয়ে যাচ্ছে নবাবের খেয়ালখুশি চরিতার্থ করতে।
নামকরণ – শ্যামনগর
প্রাচীন
কালে ‘নগর’ বলতে পাথরের বা ইটের তৈরি গৃহ সম্বলিত ধনী অথবা রাজা বা দেবতা অধিষ্ঠিত
প্রাচির ঘেরা গ্রামকেই বোঝাত। পরে এই অর্থ ক্ষয় পেয়ে ইটে গাথা দেবালয় অথবা শিবালয়
বিশিষ্ট গ্রাম কে বোঝাতে থাকে। আবার চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবের ফলে হিন্দুরাও
ব্যক্তি নামানুসারে স্থান নাম রাখতে শুরু করে। মুসলমান অধিকারের পূর্বে এদেশে
ব্যক্তি নামানুসারে স্থান নাম রাখার রেওয়াজ ছিল না। এই মত প্রকাশ করেছেন সুকুমার
সেন। এই অভিমত সত্য ধরে নিয়ে বলা যেতে পারে শ্যামনগর নামটি অর্বাচীন। পুরানো কাহিনী
বা নথি পত্রে শ্যামনগর নামে কোন গ্রাম বা মৌজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ১৮৫৯ খ্রীঃ
রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শ্যামনগর নামটি খ্যাতি পায়। যদিও তখনো শ্যামনগর
বলতে কোন সুনিদৃস্ট কোন গ্রাম কে বোঝাত না।
শ্যামনগর
নামের উৎস সন্ধানে গিয়ে কয়েক টি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অনেকে শ্যামা মন্দিরের সঙ্গে
এই নাম করনের যোগাযোগ খুঁজে পান। বর্তমান অন্নপূর্ণা কটন মিল সন্নিহিত অঞ্চলে
বর্ধমান মহারাজার গড় ছিল। সেই ‘সামনে গড়’ থেকে শ্যামনগর নাম টি এসেছে। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির মতে শ্যামাসুন্দরের মন্দিরের
থেকেই ‘শ্যামনগরের’ আগমন। বর্ধমান রাজপরিবার ১৭৪০ খ্রীঃ র কিছু পরে বর্গী
হাঙ্গামার সময় কিছুদিন কাউগাছি অঞ্চলে ছিলেন। তারাই সঙ্গে করে তাদের পারিবারিক
বিগ্রহ শ্যামকিশোর কে নিয়ে এসে ছিলেন, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় শ্যামকিশোরকে নিয়ে
যান নি এবং এই শ্যামকিশোরের নাম থেকেই এই অঞ্চলের নাম শ্যামনগর।
বর্তমান কালীবাড়ির ম্যানেজার শ্রী জীবন কানাই ভট্টাচার্য এই অভিমত কে সমর্থন করেন।
অনুমান আরও যে শ্যামনগর নাম টি এসেছে হয়তো গড়-শ্যামনগর নাম টি থেকেই। শ্যামকিশোর
গড় বেষ্টিত মন্দিরেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্ধমান মহারাজারা ১৮৫৯ খ্রীঃ কালীবাড়ির
ঠাকুরদের চেয়ে অধিকতর ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন, তাদের প্রভাবেই যখন এই
অঞ্চলে যখন রেল স্টেশন স্থাপিত হল তখন তার নাম দেওয়া হল শ্যামনগর। এই অঞ্চলের
পোস্ট অফিসের নাম ও শ্যামনগর। বর্তমানে আমরা শ্যামনগর বলতে মূলাজোড়, রাহুতা,
কাউগাছি, বিদ্যাধরপুর, হাসিয়া, আতপুর ইত্যাদি অঞ্চল সহ এক বিরাট অঞ্চলে বুঝে থাকি।
প্রাচীনতম
উল্লেখ
পঞ্চদশ
শতকের বিখ্যাত কবি বিপ্রদাস পিপিলাই- এর মনসা মঙ্গল কাব্যে চাঁদ সদাগরের
বাণিজ্যতরীর বর্তমান ভাগলপুর থেকে সাগরমুখের দিকে যাত্রার একটি মনোজ্ঞ বিবরণ আছে।
ফুলিয়া, গুপ্তিপাড়া, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম পার হয়ে বাণিজ্যতরী অতিক্রম করছে
ভাটপাড়া, মুলাজোড়, গারুলিয়া প্রভৃতি অঞ্চল। হয়তো এটাই মূলাজোড়ের প্রাচীনতম উল্লেখ।
এ থেকে অনুমান করা সম্ভবপর যে অন্ততঃ ৫০০ বছরের ও আগে মূলাজোড় একটি বর্ধিষ্ণু
অঞ্চল হিসাবেই পরিচিত ছিল। স্থানীয় মানুষদের মধ্যে এমন ধারনা রয়েছে যে বর্তমান
মূলাজোড় রাহুতা অঞ্চলগুলি আগে নদীগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। জানা যায় যে, বর্তমান ‘
পণ্ডিত পুকুর’ খননের সময়ে সেখানে জাহাজের অংশ বিশেষ পাওয়া গেছে। কাউগাছি এবং গুরদহ
অঞ্চলেও মাটির তলার থেকে নৌকার দাঁড় বা অন্যান্য অংশ বিশেষ পাওয়া গেছে বলে শোনা
যায়। এমতের সত্যতা প্রমাণ করা ভু বিজ্ঞানীদের পক্ষেই সম্ভব।
সুকুমার
সেনের মতে স্থান নাম অবশ্যই ইতিহাসের ধারক। তিনি ‘মূলাজোড়’ এই নামের ব্যাখ্যা
দিয়েছেন “ যেখানে জোড়ের ক্ষেতে মূলা হয়”। আবার “জোড়” শব্দের অর্থ “ক্ষুদ্র উপনদী”
বা ‘স্বাভাবিক জল নির্গমনের পথ’। ‘দহ’ শব্দটি গভীর জলাশয়কেই চিহ্নিত করে। ‘গুরদহ’
নামটিও তাই জলাশয়-র কথাই মনে করায়। আবার ‘গড়’ শব্দটির মধ্যেও রয়েছে জলাশয়ের
দ্যোতনা । এই অঞ্চলে ‘উচ্ছেগড়’ নামেও একটি গ্রাম পাচ্ছি। এই অঞ্চলের কতকগুলো স্থান
নাম বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায় অঞ্চলটি বিসময় জলাকীর্ণ ছিল। বিপ্রদাস পিপিলাই এঁর সাক্ষে প্রমাণ যে
মূলাজোড় ৫০০ বছর আগে বর্ধিষ্ণু অঞ্চল ছিল। বারো ভুঁইয়া দের অন্যতম প্রতাপাদিত্য
তার পর্তুগীজ সেনাপতি “ রতা” র সাহায্যে সাতটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন যার
একটি ছিল বর্তমান আতপুর অঞ্চলে। ষোড়শ শতকের শেষার্ধের ঘটনা এটা।
ভৌগোলিক
ও ঐতিহাসিক পটভূমিঃ
আতপুরে
যশোর রাজ প্রতাপাদিত্যের দুর্গ স্থাপনা থেকে বোঝা যায় এই অঞ্চলটি ছিল যশোহর
রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তোডরমলের জরিপের সময় এই অঞ্চলটি আইন-ই-আকবরী অনুযায়ী হাবেলী শহর পরগনার মধ্যে পড়ে। ভবানন্দ
যশোর রাজার বিরুদ্ধে মুঘল সম্রাটকে সাহায্য করায় সম্রাট জাহাঙ্গীর ভবানন্দ কে
নদীয়ার রাজপদে বসিয়ে ‘মহারাজ’ উপাধি দেন। এই বংশেরই সন্তান মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র
রায়। কবি ভারত চন্দ্র-র অন্নদামঙ্গল থেকে মনে হয় কৃষ্ণচন্দ্রর রাজ্য গঙ্গাসাগর
পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শ্যামনগর অঞ্চলও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রর রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত
ছিল। ১৭৯৩ খ্রীঃ লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দবস্ত চালু করলে বাংলাদেশের জমিদারীর
অনেক উলোট পালট হয়। এই সময়ে নদীয়া রাজের অর্ধেক জমিদারী হাতের বাইরে চলে যায়।
কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র ও নাতি ঈশ্বরচন্দ্রের বে হিসাবী মনোভাবের জন্যও
জমিদারীর অনেক অংশ হস্তান্তরিত হয়।
শ্যামনগরের
ইতিহাসের সঙ্গে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিশেষ যোগ রয়েছে। অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত কবি
রায়গুণাকর ভারত চন্দ্রকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বসত বাটি জন্য ছাড়াও আরও কিছু
ব্রাহ্মণ পরিবার কে ভুমিদান করে ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র
অগ্নিহোত্র ও রাজপেয় নামক মহাযজ্ঞ করেন এবং বাংলার পণ্ডিতকুল তাকে “অগ্নিহোত্রী” “বাজপেয়ী”
শ্রীমান মহারাজ রাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় উপাধিতে ভূষিত করেন। কৃষ্ণচন্দ্রও
নবদ্বীপ, কুমারহট্ট, শান্তিপুর,ভাটপাড়া এই চার পণ্ডিত সমাজের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ও
হাজার হাজার বিঘা নিষ্কর জমি ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিতরণ করেন। বলা হয়ে থাকে নদীয়া
জেলার প্রত্যেক ব্রাহ্মণ পরিবার কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে নিষ্কর জমি পেয়েছিলেন।
তন্ত্রসার রচয়িতা কৃষ্ণনন্দ আগমবাগীশ কৃষ্ণচন্দ্রের সমসাময়িক ছিলেন। আগমবাগীশ
কালীপূজার রাত্রে পথঘাট আলোকিত করার প্রথা
চালু করেন। অর্থাৎ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে বাংলায় তন্ত্র ও শাক্ত সাধনার প্রাবাল্য
ছিল।
এর
থেকেই অনুমান গোপীমোহন ঠাকুরের ব্রহ্মময়ী কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার আগেও এই অঞ্চলে
শক্তি সাধনার কোন মন্দির ছিল। কৃষ্ণচন্দ্রই বাংলাদেশে প্রথম জগধাত্রী পুজো প্রচলন
করেন। শ্যামনগরের বড়বাড়ির পূর্ব পুরুষ কৃষ্ণচন্দ্রের দান করা জমিতেই প্রতিষ্ঠা
পেয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের মধ্যে নতুন করে হিন্দু সমাজকে নেতৃত্ব দানের প্রচেষ্টা
লক্ষণীয়। নবদ্বীপ কিছুদিনের জন্য তার পুরানো
গৌরব ফিরে পেয়েছিল। মূলাজোড় গ্রাম কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মকাণ্ডের কতখানি অংশীদার সেটা
খুঁজে দেখার বিষয়। ‘শ্যামনগর’ ঠিক কখন কি ভাবে নদীয়া রাজপরিবারের হাত থেকে চলে যায়
এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জোগাড় করতে পারা যায় নি।
ছিয়াত্তরের
মন্বন্তরে (১৭৭০ খ্রীঃ) হাবেলী শহর পরগনার ১/৩ ভাগ মানুষ অনাহারে মারা যায়,
স্বভাবতই নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমানরাই সংখ্যাধিক্য ছিল অনাহারে
মৃত্যুর ক্ষেত্রে। এই সময়েই কৃষি উৎপাদন ভিত্তিক সমাজের ভিত্তিতে দেখা দিল বিরাট
ফাঁক, ফলে কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় প্রজা নিয়ে আসতে হয় অন্যত্র থেকে। ওঁরাও, সাঁওতাল
প্রভৃতি অধিবাসীদেরও এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। অনুমেয় যে এই সময়েই এই অঞ্চলের
জমিদারী গোপীমোহন ঠাকুর, শ্রীরামপুরের গোঁসাই, ফরাসডাঙ্গার পঞ্চানন ও বহরমপুরের
স্যানেদের হাতে চলে যায়। বর্ধমান মহারাজেরও একটি ছোট জমিদারী এখানে ছিল বলে জানা
যায়।
১৮৫৭
খ্রীঃ এর পর ২৪ পরগনার বনবাদাড় ও কালো মাটির গাড় অন্ধকারে ভরা গাঁয়ে ইউরোপীয়রা
শিল্পকরণের জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া লাগল এখানেও। গারুলিয়ায়
চটকল বসাতে এল টমাস ডাফ কোম্পানি, জার্মানি থেকে জারডিন-স্বীতার রা কাকিনাড়ায় এসে
গেল, দাণ্ডির কারখানা বসল জগদ্দলে, অতলান্তিক মহাসাগর পার হয়ে ডানকান ব্রাদার্স ও
এই অঞ্চলে পৌঁছে গিয়ে আরেক সমাজ বিপ্লবের সূচনা করল। কারখানা বহু মানুষকে বসতবাটি
থেকে উৎখাত করলো। আবার আশেপাশে নয়া বসতও গড়ে উঠলো। “নতুন
গ্রাম” নামে গ্রামটিও হয়েছে পুরোপুরি ভাবে গঙ্গার পার
থেকে উৎখাত হওয়া মানুষদের নিয়ে।
ভিটেমাটির
পরিবর্তন ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এই শিল্পকরন নিয়ে আসে। মানুষের জীবিকার
এল পরিবর্তন ; একান্ত কৃষি নির্ভর সমাজে ভাবনা চিন্তা সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন
নিয়ে এল। লমবার্ট স্ট্রিটের ব্যাঙ্ক অফ ইংলন্ডের ভল্টে তাল তাল সোনা জমা করার
পদ্ধতির মধ্যে এই অঞ্চলের মানুষেরা কি ভূমিকা নিয়ে ছিল তাও এখনকার ইতিহাস আলোচনার
এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শিল্পায়নের
পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলটি বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতই ছিল। ১৮ শতকের আগের
মানুষজনের পরিচয় আমরা কিছুই জানতে পারিনি। বিভিন্ন পারিবারিক ইতিহাস জোগাড় করতে
পারলে আমরা পুরানো সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো আলোকপাত করতে পারবো। মোগল যুগে
নিম্ন বর্গের মানুষ কয়েক পুরুষের বেশী এক অঞ্চলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস করতে পারেনি। ভাগ্যান্বেষণে
ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। কাজেই কবে থেকে এবং কি উপলক্ষে এ অঞ্চলে বসবাসের সূত্রপাত তা
প্রায় ক্ষেত্রেই জানা সম্ভব হয়নি। ব্যানার্জী পাড়ার আদি বাসিন্দা বলে পরিচিত বাড়ীর
বংশধর শ্রী আভাষ বন্দ্যোপাধ্যায় এঁর কাছ থেকে জানা যায় তাদের পূর্বপুরুষরা খানাকুল
কৃষ্ণ নগরের লোক। বন্যায় ভেসে যাওয়ায় তাঁরা এখানে চলে আসেন, কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ
থেকে নিষ্কর জমি পেয়ে বসবাস শুরু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় এরা শুধু পণ্ডিতি যজমানি করতেন।
পরবর্তী কালে ভিন্নতর উপায়ে অর্থোপার্জন শুরু করেন যার ফলে এক বিশাল পরিমাণ ভু-
সম্পত্তির তাঁরা অধিকারী হয়ে ওঠেন। এদের তেজারতির ব্যবসাও ছিল বলে জানা যায়। এদের
বাড়ীতে ১০০ বছরের পুরনো ঠাকুরদালান আছে । টোল ছিল কিনা জানা যায় নি। দরো, দুবনালা
পরগনায় (বর্তমান মেদিনীপুর) এদের অনেক চাষের জমি ছিল, সেই জমিও কৃষ্ণচন্দ্রের দান।
গোপী মোহন ঠাকুর এঁদের ব্রহ্মময়ী প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত হবার অনুরোধ জানালে পিরালী
ব্রাহ্মণের সেই অনুরোধে এঁরা কর্ণপাত করেননি।
মূলাজোড়ের
‘বড়বাড়ী’ বলে যারা পরিচিত তাঁরা তপন ঠাকুরের বংশধর। তপন ঠাকুর কাউগাছি রাহুতা
অঞ্চলে বাস করতেন তার ৫ম পুরুষ রামরাস তর্কালঙ্কার ও রামশঙ্কর বাচস্পতি পণ্ডিত দ্বয়ের
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, সেই সুত্রে এঁরা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে
কিছু নিষ্কর ভূসম্পত্তি পান, এই দু-জনেই অবিবাহিত থাকায় সম্পত্তি শেষ পর্যন্ত
এঁদের তৃতীয় ভাই রামকিশোরের হাতে চলে যায়। ৮ পুরুষ ধরে এঁরা মূলাজোড়ে আছেন। এখন
থেকে ৫ পুরুষ আগে রামনাথ তর্কপঞ্চানন নামে একজন বড় পণ্ডিত এই বাড়ীতে জন্মেছিলেন,
যদিও তার সম্পর্কে কোন তথ্যই উত্তরসূরিদের কাছ থেকে মেলেনি। তিন পুরুষ আগে পর্যন্ত
মূল বৃত্তি ছিল টোলে শিক্ষা দান। এই বাড়িতেই টোল ছিল এবং এখান থেকেই শিক্ষা গ্রহণ
করতেন অন্যরা। টোলটি এক সময়ে দোতলা ছিল। অনুমেয় যে বিপুল সংখ্যক ছাত্রদের জন্যই
দোতলা টোলের প্রয়োজন ছিল। তিনশো বিঘার ওপর এঁদের ভূসম্পত্তি ছিল। এখন থেকে ৬ পুরুষ
আগে রাখালদাস মজুতদারির ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। পরবর্তী কালে কেউ
কেউ তেজারতি ব্যবসা করেন। এরাও কিন্তু পিরালী ব্রাহ্মণদের কালীবাড়ির পূজারী হতে
রাজী হন নি। তিন পুরুষ আগে এঁদের বাড়ীর একজন প্রথাগত বৃত্তির বদলে চটকলের কাজে
নিযুক্ত হন।
গোপীমোহন
ঠাকুর ব্রহ্মময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন এবং বাকুড়া থেকে পুরোহিত নিয়ে আসেন
(স্থানীয় ব্রাহ্মণরা পিরালী ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের পূজারী হতে রাজী
হননি)। ব্রহ্মময়ী মন্দির ও এর সাথে দেবোত্তর সম্পত্তির দেখাশোনার জন্য বাইরে থেকে
অনেকে আসেন, গোপীমোহন ঠাকুরের এখানে জমিদারী কতটা ছিল এবং কি ভাবে এই জমিদারী ঠাকুরদের
হাতে আসে তার প্রামাণ্য তথ্য জোগাড় করা না গেলেও জানা গেছে ব্রহ্মময়ী মন্দির
প্রতিষ্ঠার সময়ে এই অঞ্চলটি ছিল পত্তনিদার নাগ-দের। এবং এরা বর্ধমান রাজের উচ্চ
রাজকর্মচারী। ঠাকুররা অনেক চেষ্টা করে নাগদের কাছ থেকে মন্দিরের জমি জোগাড় করেন
এবং জলা জংগলে পূর্ণ অঞ্চলটি সংস্কার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। অবশ্য অনেকের
মতে এই ধারনাকে বর্তমান এই মন্দির প্রতিষ্ঠার আগেই এই অঞ্চলের জমিদারী ঠাকুরদের
হাতে এসে গিয়েছিল যা তারা পেয়েছিলেন ফরাসডাঙ্গার পঞ্চানন- এর কাছ থেকে।
কাউগাছি
অঞ্চলে সতিশ সিংহ রায় ও তার পুত্রদের কাছ থেকে জানা গেছে যে তারা ছিলেন রাজপুত
ছত্রী সূর্য্য বংশীয়। অযোধ্যা থেকে এসে এদের পূর্বপুরুষরা বর্ধমান রাজার কর্মে
নিযুক্ত হন। বর্ধমানের রাজমাতা যখন বর্গী আক্রমণের আশঙ্কায় কাউগাছিতে আসেন তখন
এঁরা সম্ভবত তাদের দেহরক্ষী হয়ে এই অঞ্চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে এরা এখানকার সমাজের
অঙ্গীভূত হয়ে গেলেও এঁরা স্বীয় রাজপুত ছত্রীদের বৈশিষ্ঠ্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন,
বাঙ্গালী সমাজে এঁরা কখনো কন্যা দেন না। কন্যা নেন না। বাড়ীর উপাস্য দেবতাও
রামচন্দ্রজী । বর্ধমান রাজ পরিবার সুত্রে বেশ কিছু বাইরের লোক এ অঞ্চলে আসেন।
কাউগাছিতে গোয়াল পাড়া, ব্রাহ্মণ পাড়া, আদিবাসী পাড়ার মানুষের বসতি স্থাপনের পূর্বে
কোথায় ছিলেন তা জানা যায় নি।
রাহুতা
অঞ্চল বর্ণ হিন্দুদের। বাংলায় প্রথম বিশ্বকোষ প্রণেতা রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় ও
সাহিত্যিক ত্রৈলোক্য মুখোপাধ্যায় এর উত্তরপুরুষদের কাছ থেকে ১২৯৪ বঙ্গাব্দে ছাপা
একটি বই পাওয়া গেছে। বইটির নাম ‘ ত্রিকুল মুকুর’। এই বইতে কৌ্লিন্য প্রথা ও তৎসংলগ্ন
মেল বন্ধনের বিস্তারিত বর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে চট্ট, মুখ ও বন্দ্য এগুলি গাঞি
পরিচয় যার থেকে চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় ও বন্দ্যোপাধ্যায় এর উৎপত্তি। অবশ্য এই
প্রসঙ্গে বল্লাল সেনের কৌ্লিন্য প্রথার উল্লেখও রয়েছে যে কৌ্লিন্য প্রথা মূলতঃ
বল্লাল সেন কৃত কিনা সে বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
রাহুতার
মুখোপাধ্যায় পরিবারের কাছ থেকে জানা যায় খড়দহ মেলের আদি পুরুষ কামদেব মুখোপাধ্যায়,
কিন্তু তাঁর কোন পুরুষ কেন রাহুতায় এসে বসবাস শুরু করেন সে বিষয়ে বর্তমান পুরুষদের
কাছ থেকে কিছুই জানা যায় না। শ্রী হরে কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের রচিত “ গৌর বঙ্গ সংস্কৃতি”
লিখতে গিয়ে এই পরিবার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়েছেন। শ’ তিনেক বছর আগে এই পরিবারের
বংশধর নন্দন মুখোপাধ্যায় পূর্ব বঙ্গের এক নিচকুলোদ্ভাবা ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহ
করায় কুল কলঙ্কিত হয়। নন্দনের এই বিপদে বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মথুরানন্দ
চট্টোপাধ্যায় – এঁরা দুজন এসে শ্রী নন্দন কে অভয় দেন । তিন জনে ত্রিবেণীর ঘাটে
গিয়ে গঙ্গা জল স্পর্শ করে শপথ নেন (১) এই তিন বংশের মধ্যেই বিবাহ সীমাবদ্ধ থাকবে
(২) একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ একটির বেশী বিবাহ করবেন না (৩) পুত্র কন্যার বিবাহে
অর্থের আদান-প্রদান চলবে না। পুত্রের বিবাহে জোড়া ধুতি ও একটাকার বেশী কেউ দক্ষিণা
নিতে পারবে না।
আমাদের
অনুমান সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় ও
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার রাহুতায় আশ্রয় নেন। এই ঘটনাটি থেকে মনে হয় ১৭ শতকে সামাজিক
অত্যাচারের বিরুদ্ধে উচ্চ বাহ্মনরা একত্র হয়ে ব্যবস্থা নিতেন। অবশ্য উল্লেখ্য
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের এই বিবরণীকে রাহুতার মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের লোকেরা সত্য
বলে গ্রহণ করেন না।
ধর্ম
দুশো
বছরের বেশী ঐতিহ্যশালী মঙ্গল চণ্ডী পুজোর সন্ধান পাওয়া গেছে কাউগাছিতে। শোনা যায়
একজন ডাকাত এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। মূলাজোড় অঞ্চলের রক্ষাকালী পূজাও ১৮ শতকের বলে
দাবী করা হয়। পুজো টি প্রথমে নাকি এক তান্ত্রিক সাধু করতেন। পড়ে স্থানীয় লোকেরা
বারোয়ারী ভাবে এই পুজো চালু রাখেন। লক্ষণীয় যে রক্ষাকালী পুজোর আগে গ্রাম দেবতার
পূজো করা হয়। গ্রাম্য লৌ্কিক ঐতিহ্যকে যে একেবারেই অস্বীকার করা হয় নি – এ ঘটনা
তারই ইঙ্গিতবাহী।
বর্ধমান
মহারাজার পরিবার যে শ্যামকিশোর কে নিয়ে নিয়ে কাউগাছিতে বর্গী আক্রমণ কালে (
আনুমানিক ১৭৪১ খ্রিঃ) এসেছিলেন সেই মন্দিরটির খোজ পাওয়া যায় নি।
উনিশ
শতকের গোঁড়ায় বোধহয় ১৮০৯ খ্রীঃ বৈশাখী পূর্ণিমায় গোপীমোহন ব্রহ্মময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০ বছর ধরে
এই মন্দির তাঁর ভক্তজন দের ডেকে আনছে। মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে অনেক কাহিনী
প্রচলিত। জমিদার গোপীমোহন মা কে কন্যা রূপে আকাঙ্ক্ষা করে এক মাত্র কন্যা হিসাবে
পেয়েছেন ব্রহ্মময়ীকে। ৮ বছর বয়সে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বিয়ের দিন সকালে
ব্রহ্মময়ী গঙ্গা স্নানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে পাল্কিতে চাপিয়ে ব্রহ্মময়ীকে গঙ্গায়
নিয়ে যাওয়া হয়, কন্যা সহ পালকি গঙ্গায় চোবানোর পরে আর ব্রহ্মময়ীকে খুঁজে পাওয়া যায়
নি। এই সংবাদে গোপীমোহন কন্যার শোকে ২/৩ দিন মুহ্যমান হয়েছিলেন। দেবী পরে স্বপ্নে
দেখা দিয়ে বলেন যে তাকে মূলাজোড় গঙ্গার পাড়ে পাওয়া যাবে এবং গোপীমোহন সেখানেই
মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে যেখানে মন্দির সেখানেই মৃতদেহ পাওয়া যায়।
মতান্তরে স্বপ্ন নিদৃস্ট স্থানে পাষাণময়ী এক দেবীমূর্তি পাওয়া যায়, মৃত্তিকায় অর্ধ
প্রোথিত, কৃষ্ণ কস্টিপাথরে দক্ষিণা কালীমূর্তি, পদতলে শায়িত মহাদেব বিগ্রহ।
কালীবাড়ির বর্তমান ম্যানেজার অবশ্য এই দাবীকে গল্প কাহিনী বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন। ব্রহ্মময়ী
কোন রোগেই মারা যান ( দু এক জন কালা জ্বরে মারা গেছেন এমন বক্তব্যও পেষ করেন।)
ব্রহ্মময়ীর গায়ের রং ছিল একটু কালো এবং প্রকৃতিতে ধর্মভীরু। তবে স্বপ্নদিস্ট হয়েই
গোপীমোহন মন্দির নির্মাণ করান। ব্রহ্মময়ীর
মন্দির টি নবরত্ন মন্দির, এরকম মন্দির পশ্চিম বঙ্গে বেশী দেখা যায় নি। মন্দিরের
দক্ষিণ ও বাম পার্শ্বে ছয়টি করে সারিবদ্ধ শিব দেউল। শিব মন্দিরগুলো অবশ্য গোপীমোহন
পুত্র প্রসন্ন কুমার সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরের আভ্যান্তরিন বাতি গুলি ইউরোপীয়
প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, মন্দিরে সোপানের কাছে দুই স্তম্ভের উপর শ্বেত
পাথরের দুই সিংহ মূর্তি। উপরের আরও দুটি স্তম্ভ যার ওপর দুটি বিষ্ণু মূর্তি।
অনুমান করা হয় এই মূর্তিদুটো ব্রহ্মময়ী মূর্তির চাইতেও প্রাচীন, এদের রাজশাহীর কোন
জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ির সময় পাওয়া যায়।
পাথুরিয়াঘাটের
ঠাকুর ঐতিহ্যগত ভাবে বৈষ্ণব অথচ তারাই শক্তি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন- এটা বিস্ময়কর
বলে মনে হতে পারে। এর পেছনেও ঠাকুর পরিবারের অন্য আকাঙ্ক্ষা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠার
কারণ ছিল কি ? পীরালি ব্রাহ্মণের সমাজ প্রতিষ্ঠা ও ব্রাহ্মণ সমাজের নেতৃত্ব করার
করার আকাঙ্ক্ষা কি এই সব কর্মকাণ্ডের পেছনে কাজ
করেছে ? উচ্চ বর্ণের অনেক ব্রাহ্মণই পীরালিদের অন্নগ্রহণ করতেন না, সেই
জন্যই কি ব্রহ্মময়ী মন্দির ও সংস্কৃত কলেজের সাথে যুক্ত ব্রাহ্মণদের ঢালাও
অন্নদানের ব্যবস্থা ছিল ? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য চাই প্রয়োজনীয় তথ্য। প্রায়
১০০ বছর আগে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বাড়ীতে যে ‘গোপীনাথ জিউ’ ছিলেন তাঁকে ব্রহ্মময়ী
মন্দিরের পাশে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। গোপীনাথ এখানেই অধিস্টিত। ব্রহ্মময়ী মন্দির
ঘিরে নানা অলৌকিক ঘটনা প্রচারিত। তার সব হয়তো সত্যি নয়। দেবী এখানে পশ্চিমাস্যা
হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় রামপ্রসাদ যখন ভাগীরথী দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর গান
শোনার জন্য দেবী পশ্চিম দিকে মুখ ফেরান। সাধক রামপ্রসাদ সেন মারা যান ১৭৭২ খ্রীঃ
আর মন্দির তৈরি হয় ১৮০৯ এ। সুতরাং এই ঘটনা সত্য নয়। যতীন্দ্র মোহন ঠাকুরের সঙ্গে
বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে নিজে পূজা করে ছিলেন। মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা এ নিয়ে
গর্ব করেন। পৌষ মাসে জোড়া মুলো দিয়ে পূজো দেবার জন্য বহু দূর দূরান্ত থেকেও
ভক্তজনের আগমন ঘটে।
বর্তমান
যেখানে CESC GENERATING STATION সেখানে
একটি স্নান ঘাট ছিল। এই ঘাটের পাশে শিব মন্দির। এই মন্দিরটি বোধহয় এখানকার
প্রাচীনতম ধর্মস্থান। তবে এই মন্দিরের কথা আজ প্রায় সবাই ভুলে গেছেন।
সিদ্ধেশ্বরী
মন্দিরটির দেবী ২০০ বছরের বেশী সময় ধরে এখানে অধিস্টিত। রায়গুনাকর ভারতচন্দ্রের
আমলে এই মন্দির ছিল কিনা তা অবশ্য জানা যায় নি, শোনা যায় স্থানীয় ঘোষ পরিবার এই
মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে বাংলা দেশে যে মাতৃ সাধনার
জোয়ার বইছিল তারই ব্যক্তিগত বা আশ্রিত কারও উদ্যোগে হয়তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই
মন্দির।
অষ্টাদশ
শতকে মাকালতলা লৌকিক দেবস্থান বলে বিবেচিত হতো বলে অনেকে দাবী করেন, সাধক
রামপ্রসাদ সেন এখানেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে শোনা যায়।
এই
অঞ্চলে পুরনো কোন মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায় নি। অথচ ১০০ বছর আগেও এখানে যথেষ্ট
সংখক মুসলমান এখানে বাস করতেন। এর পেছনে কোন সামাজিক অসহিস্নুতা কাজ করছে কি? এখান
যেখানে শ্যামনগর বয়েস ক্লাব সেখানে একটি মসজিদ ছিল বলে জানা যায়, আধুনালুপ্ত
মির্জাপুর গ্রামের একাংশে পীরতলা বলে একটি জায়গা প্রভাবশালী মুসলমান পীরের কথা
স্মরণ করিয়ে দেয়। পীরতলা রক্ষনা-বেক্ষনের অবশ্য কোন ব্যবস্থা নেই। মধ্যযুগের
বাংলায় পীরেরা খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব কতটা ছিল ?
উনিশ ও বিশ শতকের ধর্ম আন্দোলনের ঢেউ এখানে বিশেষ ছাপ ফেলতে পেরেছিল বলে মনে হয়
না। আতপুর জগদ্দল অঞ্চলে কিছু ব্রাহ্ম পরিবার ও সমাজের উপস্থিতির কথা জানা যায়।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবও এখানে বিশেষ পড়েনি।
শিক্ষা
সংস্কৃতি
সপ্তদশ
শতকে বাংলায় বড় কবি বিশেষ জন্মান নি। কেবল তিন চার জনের নাম করা যায়। এদের মধ্যে
কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন ( মৃত্যু- ১৭৭২ খ্রীঃ), কবি ভারত চন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০
খ্রীঃ) এবং ভূকৈলাসের জয় নারায়ণ ঘোষাল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রকে তাঁর বসত
বাটির জন্য মূলাজোড়ে জমি দেন এবং ভারতচন্দ্র ১৭৪৯ খ্রীঃ নাগাদ এখানে বসতবাটি তৈরি
করে বাস করতে থাকেন। এই বাড়ীর ভগ্নাবশেষ এখনো আছে ( ছিল)। এই সময় বর্গীর হাঙ্গামার
আশঙ্কায় উদ্বাস্তু হয়ে বর্ধমান রাজমাতা কাউগাছিতে এসে নিজ কর্মচারী রামদেব নাগের
নামে কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে মূলাজোড়ের পত্তনি নিয়ে বাস গৃহ নির্মাণ করে বাস করতে
থাকেন, কবি এতে আপত্তি করলে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে নিঃস্বত্ব ব্রহ্মত্র রূপে জমি দান
করেন। পত্তনিদার রামদেব নাগের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কবি “নাগাস্টক” কাব্যের দ্বারা
মহারাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং মহারাজের হস্তক্ষেপে নাগের দৌরাত্ম বন্ধ হয়। ১৭৬০
খ্রীঃ মূলাজোড়ে কবি মারা যান। ভারতচন্দ্রে কাছে মূলাজোড় ছিল বার্ধক্যের বারানসী
এবং তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য “ অন্নদামঙ্গল” এই মূলাজোড়েই রচিত হয়।
মূলাজোড়ের মানুষের জীবনযাপন স্বাভাবিকভাবেই যে তাঁর কাব্যে প্রভাব ফেলে থাকবে এ
কথা বলাই বাহুল্য। তাঁর কাব্য ঈশ্বর প্রার্থনীয় ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’-
র মধ্যে দিয়ে এই অঞ্চলের নিম্ন বর্গের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার কথাই স্মরণ করিয়ে
দেয়। এমনি আরও অনেক ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর কাব্যে।
রাহুতার কৃতী পুরুষ রঙ্গলাল। জন্ম ২৪শে
আষাঢ় ১২৫০ বঙ্গাব্দ –মৃত্যু ১৭ই কার্ত্তিক ১৩১৬ বঙ্গাব্দ। বর্ধমান মহারাজা তাঁকে
“বাক্য রত্নাকর” উপাধি দিয়েছিলেন। শরৎ শশি চিত্ত, চৈতন্য উদয়, বৈ্রাগ্য, বিপিন
বিহার কাব্য, হরিদাস সাধু প্রভৃতি গ্রন্থ লিখে তিনি বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিলেন। তবে
তাঁর যুগান্তকারী কাজ বাংলায় বিশ্বকোষ রচনা যা প্রকাশিত হয়েছিল তারই তত্বাবধানে
তারই প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায় এই রাহুতা গ্রামে ১২৯০ বঙ্গাব্দে। এই গণ্ড গ্রামে বসে
এরূপ একটি কাজ রীতিমত বৈপ্লবিক এবং বাঙালীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে চিরকাল
তাঁর নাম স্মরণ করা হবে।
দেশ বিখ্যাত আরেক জন কৃতী পুরুষ রঙ্গ
লালের অপর ভ্রাতা ত্রৈলোক্য নাথ মুখোপাধ্যায়, তাঁর সাহিত্য কীর্তির জন্যও বাঙ্গালী
তাঁকে দীর্ঘদিন মনে রাখবে। তৎকালীন সময়ে বিলাত যাত্রার কারণে তিনি বেশ একটা
সামাজিক বিপ্লব উপস্থিত করে ছিলেন।
পাথুরিয়া ঘাটের ঠাকুররা ব্রহ্মময়ী
মন্দিরের পাশে সংস্কৃত কলেজ ( ১৮৯৬ খ্রীঃ) স্থাপন করে বহু বিদয়ত জনের সমাবেশ
ঘটিয়েছিলেন। ছাত্ররা এখানে পড়াশুনার সুযোগ পেতো। গোপীমোহন ঠাকুর হিন্দু কলেজ
স্থাপনের জন্য অর্থ দান করেছিলেন- যেখানে ইংরাজী শেখানো হত, কিন্তু তারই উত্তর
পুরুষ এখানে( মূলাজোড়ে) ইংরাজী শিক্ষার ব্যবস্থা না করে সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা
করে ঐতিহ্যশালী পণ্ডিতদের পঠন পাঠনের সুযোগ করে দিয়ে ছিলেন। এই সংস্কৃত কলেজের এক
সময়ে অধ্যক্ষ ছিলেন ভাটপাড়ার পণ্ডিত শিবচন্দ্র সার্বভৌম মহাশয় (১২৫৪-১৩২৬
বঙ্গাব্দ)। শিবচন্দ্র একসময় দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। ইনি মহামহোপাধ্যায়
উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর ‘কুসুমাঞ্জলি’
‘টীকা’ ‘পাণ্ডব চরিত’ ইত্যাদি হয়তো মূলাজোড়ের সংস্কৃত কলেজে বসেই রচিত বা
পরিকল্পিত। বর্তমান বড়বাড়ীতে রাম নাথ তর্ক পঞ্চানন নামে একজন বড় পণ্ডিতের জন্ম
হয়েছিল। শোনা যায় বিদ্যাসাগর মহাশয় একবার ‘ বিধবা বিবাহ’ আন্দোলন প্রসঙ্গে তাঁর
কাছে এসে ছিলেন।
সংস্কৃত কলেজ ও বড় বাড়ীর টোল ছাড়া আর কোন
সংস্কৃত শিক্ষালয়ের কথা জানা যায় না। উনবিংশ শতকেও ইংরাজী শিক্ষার প্রচলনের
চেষ্টাও বিশেষ দেখা যায় না। যারা ইংরাজী পড়তে চাইতেন তাঁরা ফরাসডাঙ্গা ও অন্যান্য
স্থানে গিয়ে পড়াশুনা করতেন। যখন বিশ্বকোষ ছাপা হচ্ছে তখনো কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
সন্ধান পাওয়া যায় নি।
রাহুতা
গ্রামের জনৈক হরকালী মুখোপাধ্যায় শিক্ষার জোরে ‘ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট’ পদে উন্নীত
হয়ে ছিলেন। সম্ভবত ১০০ বছর আগে মণ্ডল পাড়ায় সুরেন মণ্ডল নামে একজন কবিয়াল ছিলেন।
এই কবিয়ালের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাহুতার আরেক কৃতী পুরুষ কান্তিচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়। বিদ্যাবুদ্ধির জোরে তিনি রাজস্থানের জয়পুর রাজের প্রধান মন্ত্রী পদে
অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
১০০
বছর আগে বড় বাড়ীতে মুক্তমঞ্চ ছিল, ছোট বাড়ীর কৃষ্ণচন্দ্র সেখানে নাট্য নির্দেশনা
দিতেন। নাটকের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাড়ীতেই থাকতো। ১৯১৩ খ্রীঃ রাহুতা গ্রামে
নির্বাক বায়োস্কোপ দেখানো হলে চারিদিকে সাড়া পড়েছিলে। দূর দূর গ্রাম থেকে মানুষ এই
আশ্চর্য্য জিনিস দেখার জন্য ভিড় করেছিল এবং এই ভিড় সামলাতে গ্রামের মানুষ কে
যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। রাহুতা গ্রামে খেলাধুলাও এই শতাব্দীতেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
১৯১৪ খ্রীঃ প্রথম ব্যারাকপুর মহকুমা ক্লাব টুর্নামেন্টে (ফুটবল) রাহুতা গ্রামই
বিজয়ী হয়। এই অঞ্চলেই প্রথম ফুটবল মাঠ তৈরি হয়েছিল।
রাজনীতিঃ
একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক
কার্যকলাপের বিশেষ কোন খোজ পাওয়া যায় না। ১৮৫৭ খ্রীঃ সিপাই বিদ্রোহের কোন গোলা এসে
এখানকার জনজীবনে কোন আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয় নি। রাহুতার শ্যাম লাল মুখার্জী নামে
একজন নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে অনেকে বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সঠিক তথ্য
পাওয়া যায় না। রাহুতার হর কালী মুখোপাধ্যায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সময়
রাষ্ট্র গুরু সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তাঁর ডাকে স্বদেশী
আন্দোলনে যোগ দিয়ে চাকুরী ত্যাগ করেন। রাহুতার মানবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে
আরেকজন দেশ প্রেমিক ইংরাজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখে ১৯০৫ খ্রীঃ কারাবরণ করেন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কোন স্মৃতিচারণ কেউ করতে পারেননি। ওপারে চন্দননগরে বিপ্লবীদের
ঘাঁটি ছিল, কিন্তু এপারে তাঁর ছাপ পড়েনি। শিল্পায়নের ফলে যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন
জগদ্দলে গড়ে উঠে ছিল, তারও প্রভাব এই অঞ্চলে বিশেষ ছিল বলে মনে হয় না।
শেষের পরে
তথ্যের অভাবে এই আঞ্চলিক ইতিহাসের কোন
ইঙ্গিতই আমরা স্পষ্ট করে দিতে পারিনি। অকীর্তিত জনগণের কথা তাদের জীবন যাত্রা,
জীবিকার লড়াই, সম্পর্কিত তথ্য কিছুই জোগাড় করতে পারিনি। আমাদের এই দুর্বলতা আমারা
স্বীকার করে নিচ্ছি। হাঁড়ি পাড়া, কুমোর পাড়া, বাগদী পাড়ার অজস্র মানুষের কথা না
জানলে ইতিহাস রচনা অসমাপ্ত থেকে যাবে। আমরা আহ্বান করছি শ্যামনগর বা বাইরের যে কোন
মানুষের কাছে যার কাছে যে টুকু তথ্য আছে তা আমাদের দিয়ে সাহায্য করতে। আমাদের
লেখার ভিতরে কোন তথ্যগত ভুল থাকলে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
এই
তথ্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার জন্য আমরা নিম্নলিখিত পদ্ধতির কথা বলতে চাই।
১) অঞ্চলের প্রতিটি গ্রাম/পাড়ার পূর্ব নাম জোগাড়
করতে হবে। যেমন হাঁড়ি পাড়া, বাগদী পাড়া, মীর্জা পুর গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাঁড়ী
পাড়া হয়েছে গাঙ্গুলী পাড়া, বাগদী পাড়া সাহেব বাগান,- এই পরিবর্তনের পিছনে যে
সামাজিক ও রাজনৈ্তিক কারণ গুলো রয়েছে তা অনুসন্ধান করা দরকার, রাহুতার নাম করন
সম্পর্কে অনেকের অভিমত সরস্বতীর আবাস ( ‘র’- সরস্বতী) আবার রাউতারা থেকে কথাটা এসে
থাকে তা হলে কিন্তু অর্থ পালটে দাঁড়ায় অশ্বারোহীদের আবাস।
কাউগাছিতে
দর্জি পাড়া বলে একটি অঞ্চলে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাস। কি ভাবে তাঁরা এখানে এলেন
তা নিয়ে অনুসন্ধানের অবকাশ রয়েছে।
২) কোন পত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেলে
সেগুলোর সঠিক পরিচয় বের করতে হবে।
৩) এখানকার প্রাচীন রাস্তাঘাট, খালবি্
জঙ্গলের পরিচয় বের করতে হবে।
৪) প্রাচীন ‘ মসজিদ’ ‘ক্ষণ’ ‘তলা’-র পরিচয়
বের করতে হবে।
৫) ঐতিহ্যশালী পূজা, ব্রত, উৎসব, মেলার
ইতিহাসের খোঁজ নিতে হবে।
৬)
গত ২৫০ বছরে এই অঞ্চলের সঙ্গে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী , গোপীমোহন ঠাকুরের জমিদারী, ও
বর্ধমান রাজ পরিবার জড়িত, এই তিন জায়গার ইতিহাস ও নথিপত্র পরীক্ষা করতে পারলে এই
অঞ্চলের নানা ঐতিহাসিক সত্য জানা সম্ভবপর।
৭)
দলিল ও ভূমি সম্পর্কিত নথিপত্রের মধ্যে এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক উপাদান আছে। জমি
হস্তান্তরের কারণ গুলো বিশ্লেষণ করে সামাজিক/ রাজনৈ্তিক ইঙ্গিত দেওয়া যায়।
দুঃখ্যের বিষয়, এখানে যে কটি পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি তাদের কেউ-ই আমাদের
পুরনো দলিল পত্র দেখাতে খুব ইচ্ছুক ছিলেন না।
আঞ্চলিক
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উৎস পারিবারিক স্মৃতি। শুধু প্রতিষ্ঠিত পরিবার নয়- ৫০ বছর আগে
থেকে যে সব পরিবার এখানে বাস করতেন তাদের সবার কাছেই যেতে হবে এবং যুক্তির কসটি
পাথরে সেগুলিকে যাচাই করে দেখতে হবে।
অধুনালুপ্ত ‘হৈমী’ মূলত পাহাড়ে ট্রেকিং প্রেমী
যুবক ও কিশোরদের সংস্থা, সম্ভবত শ্যামনগরে এই প্রকৃতির প্রথম সংগঠন, এঁরা পাহাড়ে
চড়া ছাড়াও প্রতি বছর রক্তদান শিবির আয়োজন করতেন। এদের, এই অঞ্চলের রক্তদান
আন্দোলনের অন্যতম প্রথিকৃত বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন